‌হাথরাস:‌ ডাউন দ্য মেমোরি লেন 

  • 05 October, 2020
  • 1 Comment(s)
  • 922 view(s)
  • লিখেছেন : জিনাত রেহেনা ইসলাম
ঘরের মেয়ে পুড়ছে। পুলিশি অভিভাবকত্বে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় কুক্ষিগত ক্ষমতার কত চওড়া কপাল! ‘‌থার্ড সেকশন’‌ পুলিশ অফিসারের কথা বলার অধিকারও নেই! হিন্দুস্থান নাকি এতটাই কর্মযজ্ঞ আজ। মায়ের কান্না আর আগুনের শিখা দেখে মন কম্পিত জনগণের। উপযুক্ত সুরক্ষা ও উন্নত চিকিৎসা পেল না আক্রান্ত। আবার মৃতদেহটার প্রতিও চূড়ান্ত অবহেলা ও অন্যায় করা হল। প্রশ্নটা কি শুধুই রেপ, শুধুই পরিবারের অমতে পুড়িয়ে ফেলা? শুধুই বর্ণের। মূল প্রশ্নটা বোধহয় আরও গভীরে।

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন মুখ হাথরাস। প্রশাসনিক ক্ষমতা ও পৌরুষের দম্ভের এক নজিরবিহীন উদাহরণ। তাই অভিযুক্ত নয়, পীড়িতই ঠিকানা প্রশাসনের। ঘরের মেয়ে পুড়ছে। পুলিশি অভিভাবকত্বে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় কুক্ষিগত ক্ষমতার কত চওড়া কপাল! ‘‌থার্ড সেকশন’‌ পুলিশ অফিসারের কথা বলার অধিকারও নেই! হিন্দুস্থান নাকি এতটাই কর্মযজ্ঞ আজ। মায়ের কান্না আর আগুনের শিখা দেখে মন কম্পিত জনগণের। মৃতদেহ রাখা গাড়ির বোনেটে মহিলাদের মাথা ঠোকা, প্রতিরোধের চেষ্টা— প্রতিবাদের এমন দৃশ্য বিরল। দূর্বলের উপর সবলের সপাট মজবুত নিশানা বরাবর। সুবিধাহীন, নিরুপায় মানুষ পায়ে পড়ছে ক্ষমতাবানের। সেই পরিবারের মেয়েটির জীবন্ত দেহকে বাঁচানোর জিম্মা কিন্তু ছিল রাষ্ট্রের। উপযুক্ত সুরক্ষা ও উন্নত চিকিৎসা পেল না আক্রান্ত। আবার মৃতদেহটার প্রতিও চূড়ান্ত অবহেলা ও অন্যায় করা হল। প্রশ্নটা কি শুধুই রেপ, শুধুই পরিবারের অমতে পুড়িয়ে ফেলা? শুধুই বর্ণের। মূল প্রশ্নটা বোধহয় আরও গভীরে। এই যে, সংবিধান ও সরকার কেন? কেন নির্বাচন? অকালে মরে যাওয়া মেয়েকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানানোর অধিকারটুকু থেকেও যদি পরিবারকে বঞ্চিত করা হয় তবে রাষ্ট্র কিসের জন্য?

অবিচারের প্রতি সমবেদনার চেয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। কিন্তু এবারেও সেই অকাট্য অভ্যাসের বদল দেখা গেল না। কামদুনি থেকে দিল্লির সেই ক্ষতিপূরণ ও সরকারি চাকরির চোরা গলিতেই নিষ্পত্তির দখলদারি রইল। ক্ষমতার চেনা ছকের সেলিব্রেশনে ধর্ষণ আগের মতই পরিবারের দায় রইল। সুবিধাহীন মানুষের জন্য অনেক স্বপ্ন দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জিতে আসা সরকার ঘটনার সত্যতা থেকে এভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিল। পরে সত্য প্রকাশ হয়ে পড়লে আবার তদন্তের নির্দেশ দিল। দেহের ধর্ষণের পর আবার মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা! জনগণের দেওয়া ক্ষমতার উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এ হেন কব্জার বিরুদ্ধে প্রতিকার মানুষ চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাল্মিকী ফিরে আসবে না। এদের জন্য শুধু পড়ে থাকবে রাজনৈতিক বিতণ্ডা আর সমবেদনার সমুদ্র। 
      
রেপ কালচারকে সমাজ কখনও চ্যালেঞ্জ করে না। বরং রেপ হতেই পারে বা হবে এই একটা মানসিকতাকে স্থায়ী করা হয় সমাজে। মেয়েদের মূল লড়াইটি এই মোরেল ও অ্যাটিচিউডের বিরুদ্ধে। যৌন হিংসার স্বাভাবিকীকরণের পরিবেশ তৈরির বিরুদ্ধে। ‘রেপ পর্ন’ ও ‘নর্ম্যাল সেক্সে’র মধ্যে ফারাক স্পষ্ট না বুঝলে এই বিপদ বাড়বেই। রেপ হওয়া থেকে বাঁচতে নয়, রেপ করা থেকে বাঁচতে শেখার সুস্থতার বার্তাটা জোরালো হওয়া দরকার। রেপ অ্যাক্ট অফ ইন্সটিনক্ট শুধু নয়। অ্যাক্ট অফ পাওয়ার। অ্যাক্ট অফ বুলিয়িংও। মুশকিল হল রেপ বিষয়টিকে এখনও ছেলেদের পারস্পেক্টিভেই দেখা বন্ধ করা যায়নি। তাদের চাকরি নেই। বিয়ের মাধ্যমেই নাকি তাদের যৌনজীবন শুরু। তাই বিয়ে না করতে পেরে রেপ বাড়ছে। এমন যুক্তি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারক দিচ্ছেন। ভাবলে অবাক হতে হয় চাকরি আর সেক্স্যুয়াল ড্রাইভ শুধুই পুরুষের অধিকারের বিষয়? আসলে সমাজের মাথারাই প্যাট্রিয়ার্কির অসুখে নিমজ্জিত। জেন্ডার জাস্টিস নিয়ে গলা ফাটালেও আদৌ বিশ্বাস হয়ত করে না! 

হাথরাস স্মরণীয় হয়ে থাকবে মহিলা সাংবাদিকের ভূমিকার জন্য। নির্ভীক  সাংবাদিকতা কথাটা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। তার এক অনবদ্য নজির দেখা গেল হাথরাস। একাধারে মহিলা আধিকারিকদের উপর থেকে আসা নির্দেশ রক্ষার দায় অন্যদিকে মহিলা সাংবাদিকদের আকুতি— আপনিও তো মেয়ে! বাল্মিকী তখন ইউনিভার্সাল ডটার। সকলেই বিচার চায় একযোগে! অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চায় একমুখে, একপ্রাণে। ম্যাপের এলাকাকে একে একে চিনিয়ে দিচ্ছে প্রতিবার এই সরল, সুন্দর মেয়েরা। যাদের দেখে চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙার কথা ছিল। কিন্তু এদের জীবনের বিনিময়ে জানা হচ্ছে আসলে সমাজ কতখানি পেছনের দিকে হেঁটে চলেছে। রাষ্ট্রের শক্তি ও জনপ্রিয়তার আধারে বাল্মীকিরা জেগে থাকছে শুধুমাত্র একটি ঘটনা হয়ে। যেখানে অনাবিল কান্না আছে, বিতর্ক আছে। শুধু বাঁচিয়ে রাখার কৌশলটাই নেই। অন্যায়কারীকে চিরতরে দমন করার ব্যবস্থা নেই। ‘আর নয়’ এই প্রতিজ্ঞা নেই।         
       
মেক্সিকোতে গ্লিটার রেভোলিউশন হচ্ছে। ফেমিসাইডের বাড় বাড়ন্ত দেখে প্রতিবাদে মেয়েরা গিয়ে সরকারি দপ্তর দখল করছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলির একটি করে মহিলা শাখা আছে। পার্টির মহিলা উইংটিকে আজও সাবালক হতে দেখে গেল না। তাই প্রতিবাদে দপ্তর দখল তো অনেক বড় কথা। জনসংখ্যার অনুপাতে মেয়েরা যদি প্রতিবাদের গণমুখ হয়ে উঠতে পারত তবে রেপ নিয়ে এমন প্রশাসনিক ছেলেখেলা হয়ত হত না। বাল্মিকীর প্রদেশের সরকার আবার বিশ্বাস করে মেয়েরা কিছুই পারে না একা একা। প্রয়োজনে মেয়েদের সম্মান রক্ষার সংকল্পও মুখে। প্রথমটি যদি বিশ্বাস হয় তবে দ্বিতীয় স্টেটমেন্ট নিশ্চিত ভাবে মিথ্যা। মেয়েদের ক্ষমতায় বিশ্বাস না করলে তাদের সম্মান করা যায় না। 

যে আক্রোশ বা সুপিরিওরিটি থেকে পুরুষ রেপ করে সেটা আটকাতে গেলে পুলিশ-‌প্রশাসন-‌আইন শুধু নয়, মেয়েদের একজোট হয়ে অ্যাক্টিভ পার্টিসিপেশনে নামতে হবে। ‘আমি রাজনীতি বুঝিনা’ বা ‘হাঁটতে পারিনা’ বা ‘মিছিলে, জমায়েতে যাওয়ার পারমিশন নেই’ পুরুষতন্ত্রের শেখানো ছকের বাইরে ভাবতে হবে।    অধিকাংশ রেপের অভিযোগ মিথ্যা— এই মিথের বিরুদ্ধে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করতে হবে। কেননা অভিযোগই নথিভুক্ত হয়না সামাজিক ও প্রশাসনিক বিরুদ্ধ বাতাবরণের কারণে। তাই যারা এগিয়ে আসে তাদের বিশ্বাস করার একটা নৈতিক দায় থাকে। এগিয়ে আসার আত্মবিশ্বাস বেশি করে জোগাতে হবে। লজ্জার ভয় ,অভিযুক্তের আক্রমণের ভয়, অবিশ্বাসের ভয়, পরিবারের অসম্মানের ভয় এগুলি যৌন হিংসার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে সমস্যা। এইসব ‘ফিয়ার ফ্যাক্টর’কে অতিক্রম করার ভার সর্বস্তরের মেয়েদের ওপর বর্তায়। অভিযুক্তকে ঘৃণ্য করে তোলা এবং তাদের অন্যায়কে বেশি করে সর্বস্তরে অ্যাক্সেস হতে দেওয়ায় জন্য পদক্ষেপ দরকার। সেটা সত্যিই হয়ে ওঠেনি আজও। তাই হাথরাসের আগুন নিভে গেলেও পড়ে থাকা ছাই জানান দিচ্ছে শিষ্টাচারের ঘাটতির কথা। সামাজিক শালীনতা উলঙ্ঘনের কথা! রাষ্ট্রযন্ত্রের দেওলিয়া আচরণের কথা!

ছবি:‌ সংগৃহীত
লেখক:‌  শিক্ষক ও সমাজকর্মী 

1 Comments

Sarbani Guha Ghosal

05 October, 2020

excellent analysis

Post Comment